প্রতিদান কবিতার ব্যাখ্যা ও মূলভাব
উচ্চমাধ্যমিক বাংলা প্রথম পত্রের কবি জসীমউদ্দীন রচিত প্রতিদান কবিতার ব্যাখ্যা ও মূলভাব নিচে দেওয়া হলো।
কবি জসীমউদ্দীনের ‘বালুচর’ কাব্যগ্রন্থ থেকে ‘প্রতিদান’ কবিতাটি সংকলিত হয়েছে। পল্লি-কবি জসীমউদ্দীনের লেখা প্রতিদান কবিতার ব্যাখ্যা নিচে দেওয়া হলো।
প্রতিদান কবিতার মূলভাব
‘প্রতিদান’ কবিতাটি কবি জসীমউদ্দীনের ‘বালুচর’ কাব্যগ্রন্থ থেকে সংকলিত। এ কবিতায় কবি ক্ষুদ্র স্বার্থকে বিসর্জন দিয়ে পরার্থপরতার মধ্যেই যে ব্যক্তির প্রকৃত সুখ ও স্বার্থকতা নিহিত সেই বিষয়ে আলোকপাত করেছেন। সমাজ-সংসারে বিদ্যমান বিভেদ-হিংসা-হানাহানি দ্বারা আক্রান্ত হওয়া সত্ত্বেও কবির কন্ঠে প্রতিশোধ-প্রতিহিংসার বিপরীতে ব্যক্ত হয়েছে প্রীতময় এক পরিবেশ সৃষ্টির আকাঙ্ক্ষা। কেননা ভালোবাসাপূর্ণ মানুষই নির্মাণ করতে পারে সুন্দর, নিরাপদ পৃথিবী। কবি অনিষ্টকারীকে কেবল ক্ষমা করেই নয়, বরং প্রতিদান হিসেবে অনিষ্টকারীর উপকার করার মাধ্যমে পৃথিবীকে সুন্দর, বাসযোগ্য করতে চেয়েছেন।
প্রতিদান কবিতার ব্যাখ্যা
কবিতায় পরের কল্যাণে আত্মস্বার্থ পরিত্যাগের কথা বলা হয়েছে। অপরের কল্যাণের মধ্যেই প্রকৃত সুখ নিহিত। তাই কবিও অপরের জন্য ত্যাগ স্বীকার করতে চান। সমাজের হিংসা-বিদ্বেষের মধ্যে যদি কবি কারো দ্বারা ক্ষতিগ্রস্তও হন, তবুও তার মঙ্গল কামনাই করে যেতে চান কবি। হিংসা-বিদ্বেষের বিপরীতে কবি শুনিয়েছেন সম্প্রীতির মহান বাণী। অনিষ্টকারীর কোনো ক্ষতি না করে উল্টো তার উপকার করার মাধ্যমে কবি স্নেহ-ভালোবাসপূর্ণ সম্পর্ক প্রত্যাশা করেন। আর মানুষে মানুষে স্নেহ-ভালোবাসাপূর্ণ সম্পর্কই গড়ে তুলতে পারে সুন্দর ও নিরাপদ পৃথিবী।
উৎস ও পরিচিতি
‘প্রতিদান’ কবিতাটি কবি জসীমউদ্দীনের ‘বালুচর’ কাব্যগ্রন্থ থেকে সংকলিত হয়েছে।
নামকরণঃ ‘প্রতিদান’ কবিতায় অপকারকারীর উপকার করার কথা বলা হয়েছে। অন্যের উপকার করার মধ্যেই যে প্রকৃত সুখ রয়েছে তার কথা বলা হয়েছে। কবি তাঁর অনিষ্টকারীকে ক্ষমা করে দিতে চেয়েছেন। এমনকি সেই অনিষ্টকারীর ক্ষতি না করে উপরন্তু তার উপকার করার মাধ্যমে ভালোবাসার অনুপম দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে চেয়েছেন। যে কবির ক্ষতি চেয়েছে, কবি প্রতিদানে তার উপকার করতে চেয়েছেন। এই দৃষ্টিকোণ থেকে কবিতাটির নাম ‘প্রতিদান’ যথার্থ ও অর্থবহ।
রূপশ্রেণিঃ কবিতাটির প্রতিটি পঙ্ক্তিতে অন্ত্যমিল আছে।
ভাষা ও ছন্দঃ ‘প্রতিদান’ কবিতাটি মাত্রাবৃত্ত ছন্দে রচিত।
প্রতিদান কবিতার প্রসঙ্গ পরিচয়
কবি জসীমউদ্দীন বাংলা সাহিত্যে ‘পল্লিকবি’ হিসেবে সমধিক পরিচিত। পল্লিজীবন তাঁর কবিতার প্রধান উপজীব্য। বাংলার গ্রামীণ জীবনের আবহ, সহজসরল প্রাকৃতিক রূপ, উপযুক্ত শব্দ, উপমা ও চিত্রের মাধ্যমে তাঁর কাব্যে অনন্যসাধারণ রূপ লাভ করেছে। তাঁর মধ্যে এক সরল মন ছিল বলেই তিনি পল্লির খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষদের নিয়ে সাহিত্য রচনায় মনোনিবেশ করতে পেরেছিলেন। ‘প্রতিদান’ কবিতাটি গৃহীত হয়েছে কবির ‘বালুচর’ কাব্যগ্রন্থ থেকে, যা ১৯৩০ সালে প্রকাশ লাভ করে।
বাংলা কবিতার কালপরিক্রমায় বিংশ শতকের ত্রিশের দশকটি বিশেষভাবে তাৎপর্যমণ্ডিত। মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখদের হাত ধরে আধুনিক বাংলা কবিতার যে যাত্রা শুরু হয় তা এই দশকের কবিদের মাধ্যমে এসে পূর্ণতা পেল। এই সময়ের উল্লেখযোগ্য কবিগণ ইউরোপীয় শিল্প- সাহিত্যের অনুপ্রেরণায় সম্পূর্ণ নতুন ধারার কবিতা রচনায় ব্রতী হন। তাঁদের কবিতায় রবীন্দ্রবলয় ছিন্ন করার প্রবণতা, শূন্যতাবোধ, অক্ষরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, শহরকেন্দ্রিকতা, অস্তিত্বের টানাপোড়েন ইত্যাদি বিষয় লক্ষ করা যায়।
কবি জসীমউদ্দীন সচেতনভাবেই এই দলে ভেড়েননি। বরং পল্লির মাটি ও মানুষের কথা কবিতায় তুলে ধরে সম্পূর্ণ একটি নিজস্ব কাব্যধারা সৃষ্টিতে মনোযোগী হন। তবে সমাজসচেতনতা যে তাঁর মাঝে পুরোমাত্রাতেই ছিল তা ‘প্রতিদান’ কবিতায় স্পষ্ট। তৎকালীন সময়টি ছিল ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ, সর্বত্র আধুনিকায়নের আহ্বান। গ্রামকেন্দ্রিক অর্থনীতির বিপরীতে শহুরে শিল্পয়ান ও নগরায়নের জোরালো আগমনী বার্তা ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। নাগরিক জীবনের বিচ্ছিন্নতা, ক্লেদ মানুষকে ধীরে ধীরে গ্রাস করছে।
ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে মানুষের জাতীয়তাবাদী চেতনা ও বিদ্রোহী সত্তারও জাগরণ ঘটেছে বহুগুণে। এমন সংকটময় মুহূর্তে মানুষে মানুষে দূরত্ব লক্ষ করে প্রাণ কেঁদেছে পল্লিকবির। ‘প্রতিদান’ কবিতায় কবি তাই তুলে ধরেছেন প্রেম ও প্রীতির উদার, মহৎ বাণী। প্রতিহিংসার বিপরীতে ধ্বনিত হয়েছে ভালেবাসার অমিয় আহ্বান । বর্তমান সমাজের প্রেক্ষাপটেও কবিতাটি নিঃসন্দেহে প্রাসঙ্গিক। মানুষে মানুষে একতার দেখা পাওয়া আজ. ভার, ব্যক্তিস্বার্থ রক্ষায় অসুস্থ প্রতিযোগিতায় গোটা সমাজ জর্জরিত। ‘প্রতিদান’ কবিতার মর্মবাণী আমাদের আহ্বান করে মানুষকে ভালোবাসার মাধ্যমে সৌহার্দপূর্ণ, মানবিক একটি সমাজ গড়ে তুলতে।