Bangla

বিদ্রোহী কবিতার ব্যাখ্যা ও মূলভাব

উচ্চমাধ্যমিক বাংলা প্রথম পত্রের কাজী নজরুল ইসলাম রচিত বিদ্রোহী কবিতার ব্যাখ্যা ও মূলভাব নিচে দেওয়া হলো।

‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি কাজী নজরুল ইসলামের ‘অগ্নিবীণা’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত। এটি কবির প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ। ‘অগ্নিবীণা’ কাব্যগ্রন্থের দ্বিতীয় কবিতাটিই ‘বিদ্রোহী’। কাজী নজরুল ইসলামের লেখা “বিদ্রোহী” কবিতার ব্যাখ্যা নিচে দেওয়া হলো।

বিদ্রোহী কবিতার মূলভাব

“বিদ্রোহী” বাংলা সাহিত্যের একটি শ্রেষ্ঠ্য কবিতা। রবীন্দ্রযুগে এ কবিতার মধ্য দিয়ে এক প্রাতিস্বিক কবিকন্ঠের আত্মপ্রকাশ ঘটে যা বাংলা কবিতার ইতিহাসে এক বিরল স্মরণীয় ঘটনা।

“বিদ্রোহী” কবিতায় আত্মজাগরণে উন্মুখ কবির সদম্ভ আত্মপ্রকাশ ঘোষিত হয়েছে। কবিতায় সগর্বে কবি নিজের বিদ্রোহী কবিসত্তার প্রকাশ ঘটিয়ে ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষের শাসকদের শাসন ক্ষমতার ভিত কাঁপিয়ে দেন। এ কবিতায় সংযুক্ত রয়েছে ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে কবির ক্ষোভ ও বিদ্রোহ। কবি সকল অন্যায় অনিয়মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করতে গিয়ে বিভিন্ন ধর্ম, ঐতিহ্য, ইতিহাস ও পুরাণের শক্তি উৎস থেকে উপকরণ উপাদান সমীকৃত করে নিজের বিদ্রোহী সত্তার অবয়ব রচনা করেন। কবিতার শেষে ধ্বনিত হয় অত্যাচারীর অত্যাচারের অবসান কাম্য। বিদ্রোহী কবি উৎকণ্ঠ ঘোষনায় জানিয়ে দেন যে, উৎপীড়িত জনতার ক্রন্দনরোল যতদিন পর্যন্ত না প্রশমিত হবে ততদিন এই বিদ্রোহী কবিসত্তা শান্ত হবে না। এই চির বিদ্রোহী অভ্রভেদী চির উন্নত শিররূপে বিরাজ করবে।

বিদ্রোহী কবিতার ব্যাখ্যা

‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি কবির এক অনন্য সৃষ্টি। এ কবিতায় আত্মজাগরণের জন্য উন্মুখ কবি আপন সত্তার সগর্ব প্রকাশ ঘটিয়েছেন। এখানে কবি বীর; বীরধর্মের অনুসারী তিনি চিরবিদ্রোহী। এই বিদ্রোহী সত্তা অকুতোভয় ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিধ্বংসী। তাঁর এই বিদ্রোহ অসাম্যের বিপরীতে এবং আর্তমানবতার পক্ষে আশার আলো দেখায়। কবিতাটির মধ্যদিয়ে কবি মূলত ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ক্ষোভ ও বিদ্রোহ প্রকাশ করেছেন । আর তা করতে গিয়ে তিনি বিভিন্ন ধর্ম, ঐতিহ্য, ইতিহাস ও পুরাণ থেকে উপকরণ ও অনুষঙ্গ নিয়ে নিজের বিদ্রোহী সত্তাকে রূপদান করেছেন। এই বিদ্রোহী সত্তার একমাত্র লক্ষ্য— অত্যাচারের অবসান। আর তাই তিনি ঘোষণা করেন, যতদিন পর্যন্ত উৎপীড়িতের ক্রন্দনরোল বন্ধ হবে না, ততদিন পর্যন্ত কবির এই বিদ্রোহী সত্তা লক্ষ্যে অবিচল থাকবে। বিদ্রোহী এই কবিসত্তা শেষ পর্যন্ত অভ্রভেদী চির উন্নত-শির রূপে বিরাজ করবে।

কবিতার উৎস

‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি কবির ‘অগ্নিবীণা’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত। এটি কবির প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ। এ কাব্যগ্রন্থের দ্বিতীয় কবিতাটিই ‘বিদ্রোহী’।

নামকরণ: বিষয়বস্তুকে অবলম্বন করে।

রূপশ্রেণি: কবিতা।

ভাষারীতি: সাধু ও চলিত রীতি।

বিদ্রোহী কবিতার প্রসঙ্গ পরিচয়

নজরুলের অন্যান্য রচনার মতো তাঁর ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটিও তাঁর নিজ অভিজ্ঞতা ও আত্মদর্শনের ফল। এক্ষেত্রে কবিতাটির মর্মার্থ ভালোভাবে বুঝতে হলে সবার আগে নজরুলের সমকালীন সমাজব্যবস্থা ও পরিবেশ- পরিস্থিতির দিকে নজর দিতে হবে।

১৮৯৯ সালে একটি পরাধীন দেশে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ব্রিটিশশাসিত ভারতবর্ষে তখন চরম দুঃসময়। চারদিকে অনাচার- একদিকে দারিদ্র্যের কশাঘাত, অন্যদিকে ধনী-গরিব, জাতি-ধর্মের বৈষম্য সমাজব্যবস্থাকে ভঙ্গুর করে তুলছে। পাশাপাশি ঔপনিবেশিক শক্তির শোষণ ও পরাধীনতার গ্লানি সেসময় নজরুলকে ভাবিয়ে তুলেছিল। সংগত কারণেই সমাজ-সচেতন কবি এ অবস্থা থেকে উত্তরণ চাইছিলেন। তাঁর সমস্ত লেখনীতে, গানে ও কবিতায় এ বিষয়টির ছাপ স্পষ্ট। তাছাড়া ব্যক্তিগত জীবনেও নজরুল দারিদ্র্যের কশাঘাতে জর্জরিত ছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে সৃষ্ট মানবিক বিপর্যয়কে অবলোকন করেছিলেন তিনি। নজরুলের দর্শন তাই প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার ফল এবং তা তাঁর আত্মসত্যেরই প্রতিরূপ।

এ চেতনাকে ধারণ করেই আলোচ্য কবিতাটিতে কবি সকল অন্যায় এবং অসাম্যের বিরুদ্ধে দ্রোহ ঘোষণা করেছেন। তাঁর এই দ্রোহ আর্তমানবতার পক্ষে এবং পরাধীনতা ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে আলোকবর্তিকা সদৃশ। যা কিছু নষ্ট, পুরাতন ও কুসাংস্কারাচ্ছন্ন কবির দ্রোহ সে সবকিছুর বিরুদ্ধেই। প্রথাবদ্ধ জীবন ও শৃঙ্খলকে ভেঙে নতুন করে গড়তে চান তিনি। তাঁর বিশ্বাস, তাঁর এই দ্রোহই একদিন পরাধীন জাতিকে পৌঁছে দেবে মুক্তির সীমায়।

এ আপ্ত সত্যকে ধারণ করেই কবিতাটিতে তিনি ঘোষণা করেছেন— ‘আমি সেই দিন হব শান্ত, যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না।’ এ চরণটি থেকেই বোঝা যায় কবিতাটিতে কবি কেবল দ্রোহের কথাই বলেননি, মানবপ্রেমেরও জয়গান গেয়েছেন। বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয় এ কবিতার আর একটি চরণের মধ্য দিয়ে। যেখানে কবির দৃপ্ত উচ্চারণ— মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী আর হাতে রণ-তূর্য। সত্যিকার অর্থেই কবি দ্রোহের সঙ্গে সঙ্গে মানবপ্রেমকেও চেতনায় ধারণ করেছিলেন। আর এই প্রেম ও দ্রোহের মৌলিক প্রেরণা ছিল তাঁর স্বোপার্জিত আত্মদর্শন, যার মুখ্য উদ্দেশ্য সর্বাঙ্গীণ মুক্তি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button