বৃক্ক কাকে বলে? বৃক্কের গঠন ও কাজ
বৃক্ক মানবদেহের প্রধান রেচন অঙ্গ। বৃক্ক কী বা বৃক্ক কাকে বলে ও বৃক্কের গঠন এবং বৃক্কের কাজ নিচে বিস্তারিত উল্লেখ করা হলো।
বক্ষপিঞ্জরের ঠিক নিচে উদর গহ্বরের কটি অর্থাৎ কোমর অঞ্চল এ মেরুদণ্ডের দুপাশে একটি করে মোট দুটি বৃক্ক থাকে। বৃক্কের উপরের প্রান্ত দ্বাদশ থোরাসিক কশেরুকার নিচে এবং নিচের প্রান্ত তৃতীয় লাম্বার কশেরুকার উপরে অবস্থিত। উদর গহ্বরে যকৃতের অবস্থানের কারণে বাম বৃক্কটি ডান বৃক্কের তুলনায় সামান্য উপরে অবস্থিত। বৃক্ক দেখতে অনেকটা শিম বীজের মতো। এর পার্শ্বদেশ উত্তল, ভিতরের দিক অবতল।
বৃক্ক কাকে বলে?
দেহের বর্জ্য নিষ্কাশনের কাজটা যে অঙ্গ করে, তাকে বৃক্ক বা কিডনি বলে। বৃক্ক বা কিডনি মেরুদণ্ডী প্রাণিদেহের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ যা দেহের রেচন তন্ত্রের প্রধান অংশ। এর প্রধান কাজ রক্ত ছেঁকে বর্জ্য পদার্থ পৃথকীকরণ ও মূত্র উৎপাদন।
বৃক্কের গঠন
বৃক্কের উত্তল এবং অবতল পৃষ্ঠ রয়েছে। অবতল পৃষ্ঠের গভীরতম অংশকে বৃক্কীয় হাইলাম বলে। এর মধ্য দিয়ে বৃক্কের ধমনী প্রবেশ করে এবং বৃক্কের শিরা ও মূত্রনালি বের হয়।
বাহ্যিক গঠন: প্রতিটি বৃক্ক নিরেট, চাপা দেখতে অনেকটা শিম বীজের মতো এবং কালচে লাল রংয়ের। একটি পরিণত বৃক্কের দৈর্ঘ্য ১০-১২ সেন্টিমিটার, প্রস্থ ৫-৬ সেন্টিমিটার এবং স্থূলত্ব ৩ সেন্টিমিটার। একেকটির ওজন পুরুষে ১৫০-১৭০ গ্রাম এবং নারীদেহে ১৩০-১৫০ গ্রাম । বৃক্কের বাইরের দিক উত্তল ও ভিতরের দিক অবতল। অবতল অংশের ভাঁজকে হাইলাম বলে। হাইলামের মধ্য দিয়ে ইউরেটার ও রেনাল শিরা বহির্গত হয় এবং রেনাল ধমনি ও স্নায়ু বৃক্কে প্রবেশ করে। সম্পূর্ণ বৃক্ক ক্যাপসুল নামক তন্তুময় যোজক টিস্যুর সুদৃঢ় আবরণে বেষ্টিত।
অন্তর্গঠন: বৃক্কের লম্বচ্ছেদে তিনটি সুস্পষ্ট অংশ দেখা যায়: বাইরে অবস্থিত অপেক্ষাকৃত গাঢ় অঞ্চলটি কর্টেক্স, মধ্যখানে হালকা লাল রঙের মেডুলা এবং ভিতরে সাদাটে পেলভিস। বৃক্কের সর্ববহিঃস্থ ও শক্ত তন্তুময় যোজক টিস্যুতে এবং অসংখ্য রেনাল করপাসল (খালি চোখেও দেখা যায়) ও নেফ্রনের অংশবিশেষ নিয়ে কর্টেক্স গঠিত।
কর্টেক্সের নিচে হালকা লাল রঙের মেডুলা অংশ ৮–১৮টি পিরামিড আকৃতির অংশ নিয়ে গঠিত। এগুলো রেনাল পিরামিড। নেফ্রনের নালিকাময় অংশ ও রক্তবাহিকা নিয়ে একেকটি পিরামিড নির্মিত হয়। পিরামিডের গোড়া থাকে কর্টেক্সের দিকে, আর ১০-২৫টি ছিদ্রযুক্ত চূড়া বা প্যাপিলা থাকে রেনাল পেলভিসে উন্মুক্ত। দুই রেনাল পিরামিডের কর্টেক্সের কিছু অংশ স্তম্ভের মতো মেডুলার গভীরে প্রবেশ করেছে। এগুলোকে রেনাল কলাম বলে।
বৃক্কের অভ্যন্তরে অবস্থিত ইউরেটারের অংশটি উপর দিকে ফানেলের মতো প্রসারিত অংশে পরিণত হয়ে রেনাল পেলভিস গঠন করেছে। প্রশস্ত পেলভিসটি উপর দিকে কয়েকটি শাখা-প্রশাখায় রূপ নিয়েছে। এর মধ্যে ২-৩টি হচ্ছে প্রধান শাখা যা মেজর ক্যালিক্স নামে পরিচিত। মেজর ক্যালিক্স বিভক্ত হয়ে মোট ৮–১৪টি মাইনর ক্যালিক্স সৃষ্টি করে। বৃক্কে মূত্র সৃষ্টি হলে প্রথমেই তা রেনাল প্যাপিলা হয়ে মাইনর ক্যালিক্সে প্রবেশ করে। এখান থেকে মূত্র মেজর ক্যালিক্স হয়ে রেনাল পেলভিস অতিক্রম করে ইউরেটারে বাহিত হয়। ক্যালিক্স, পেলভিস ও ইউরেটারের প্রাচীরে এমন এক ধরনের সংকোচনশীল উপাদান থাকে যার প্রভাবে মূত্র মূত্রথলির দিকে ধাবিত হয়।
বৃক্কের কাজ
মূত্র উৎপাদন বৃক্কের প্রধান কাজ হলেও এটি নিম্নলিখিত বিভিন্ন কাজ সম্পন্ন করে থাকে। বৃক্কের কাজগুলো নিচে দেওয়া হলো।
১। বৃক্ক দেহের বিপাকের ফলে উৎপন্ন বর্জ্যপদার্থগুলো, যেমন-ইউরিক এসিড, ক্রিয়েটিনিন ইত্যাদি মূত্র সৃষ্টির মাধ্যমে দেহ থেকে বের করে দেয়, ফলে রক্ত বর্জ্যমুক্ত হয়ে পরিশোধিত হয়।
২। দেহে পানির পরিমাণ স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি হলে বৃক্ক বেশি মূত্র তোর করে আবার পানির ঘাটতি থাকলে কম মূত্র সৃষ্টির মাধ্যমে বৃক্ক দেহে পানির সমতা বজায় রাখে।
৩। বৃক্ক থেকে বিভিন্ন টক্সিক পদার্থ, ভেষজ পদার্থ, রঞ্জক, অতিরিক্ত ভিটামিন, ওষুধ ও হরমোন বহিষ্কৃত হয়; বৃক্কের মাধ্যমে রক্ত থেকে অতিরিক্ত চিনি ও অ্যামিনো এসিড অপসারিত হয়।
৪। বৃক্ক দেহের খনিজ লবণ ও বাইকার্বনেটের মাত্রা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে অম্ল-ক্ষার সমতা বজায় রাখতে সাহায্য করে।
৫। বৃক্ক রক্তের সোডিয়াম, পটাসিয়াম, ক্যালসিয়াম ইত্যাদি খনিজ লবণের সাম্যতা নিয়ন্ত্রণ করে।
৬। বৃক্ক দেহে রক্ত ও কোষ-টিস্যুর অভিস্রবণিক চাপ নিয়ন্ত্রণ করে।
৭। দেহের পানির সমতা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে, বিভিন্ন হরমোনের সাহায্যে বৃক্ক রক্তচাপকে নিয়ন্ত্রণ করে।
৮। বৃক্ক রক্তের রক্তরস ও রক্তকণিকার উপাদান নির্দিষ্ট রাখে।
৯। বৃক্কে এরিথ্রোপয়েটিন, প্রোস্টাগ্ল্যান্ডিন এবং অ্যানজিওটেনসিন হরমোন উৎপন্ন হয়। এরিথ্রোপয়েটিন এরিথ্রোসাইট উৎপাদনে উদ্দীপনা জোগায়।
১০। বৃক্ক রেনিন নামক এক প্রকার এনজাইম ক্ষরণ করে যার কার্যকারিতা হরমোনের মতো।
১১। বৃক্ক রক্ত থেকে বিভিন্ন অপ্রয়োজনীয় বস্তু অপসারিত করে দেহের অভ্যন্তরীণ পরিবেশকে স্থিতাবস্থায় রাখে।
১২। দীর্ঘ সময় অনাহারে থাকলে বৃক্ক গ্লুকোনিওজেনেসিস প্রক্রিয়ায় প্রোটিন ও লিপিড থেকে শর্করা উৎপাদন করে। এসময় বৃক্ক প্রায় ২০% গুকোজ সরবরাহ করতে পারে।
১৩। বৃক্ক দেহে পানি, গুকোজ ও অ্যামিনো এসিড পুনঃশোষণের সাথে জড়িত।
১৪। বৃক্ক ভিটামিন-D এর কার্যকর রূপ তৈরিতে প্রধান ভূমিকা রাখে। ভিটামিন-D হার ও দাঁত মজবুত করে।
এখানে মানবদেহের প্রধান রেচন অঙ্গ বৃক্ক কাকে বলে, এর গঠন এবং কাজ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।