Bangla

আমার পথ প্রবন্ধের ব্যাখ্যা ও মূলভাব

HSC বাংলা প্রথম পত্রের প্রমথ চৌধুরী রচিত আমার পথ প্রবন্ধের ব্যাখ্যা এবং মূলভাব নিচে প্রকাশ করা হলো।

‘আমার পথ’ প্রবন্ধটি কাজী নজরুল ইসলামের বিখ্যাত প্রবন্ধগ্রন্থ ‘রুদ্র-মঙ্গল’ থেকে সংকলিত হয়েছে। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের লেখা “আমার পথ” প্রবন্ধের ব্যাখ্যা নিচে দেওয়া হলো।

আমার পথ প্রবন্ধের মূলভাব

প্রবন্ধটি কাজী নজরুল ইসলামের সুবিখ্যাত প্রবন্ধগ্রন্থ ‘রুদ্র-মঙ্গল’ থেকে সংকলিত হয়েছে। “আমার পথ” প্রবন্ধে নজরুল এমন এক ‘আমি’র আবাহন প্রত্যাশা করেছেন যার পথ সত্যের পথ; সত্য প্রকাশে তিনি নির্ভীক অসংকোচ। তাঁর এই ‘আমি’-ভাবনা বিন্দুতে সিন্ধুর উচ্ছ্বাস জাগায়। নজরুল প্রতিটি মানুষকে পূর্ণ এক ‘আমি’র সীমায় ব্যাপ্ত করতে চেয়েছেন; একইসঙ্গে, এক মানুষকে আরেক মানুষের সঙ্গে মিলিয়ে ‘আমরা’ হয়ে উঠতে চেয়েছেন। স্বনির্ধারিত এই জীবন-সংকল্পকে তিনি তাঁর মতো আরও যারা সত্যপথের পথিক হতে আগ্রহী তাদের উদ্দেশে ছড়িয়ে দিতে চান। এই সত্যের উপলব্ধি কবির প্রাণপ্রাচুর্যের উৎসবিন্দু। তিনি তাই অনায়াসে বলতে পারেন, ‘আমার কর্ণধার আমি। আমার পথ দেখাবে আমার সত্য।’

রুদ্র-তেজে মিথ্যার ভয়কে জয় করে সত্যের আলোয় নিজেকে চিনে নিতে সাহায্য করে নজরুলের এই ‘আমি’ সত্তা। তাঁর পথনির্দেশক সত্য অবিনয়কে মেনে নিতে পারে কিন্তু অন্যায়কে সহ্য করে না। সমাজ ও সমকাল পর্যবেক্ষণের মধ্য দিয়ে প্রাবন্ধিক দেখেছেন যে, সুস্পষ্টভাবে নিজের বিশ্বাস আর সত্যকে প্রকাশ করতে না জানলে তৈরি হয় পরনির্ভরতা, আহত হয় আমাদের ব্যক্তিত্ব। নজরুলের কাছে এই ভগ্ন আত্মবিশ্বাসের গ্লানি গ্রহণযোগ্য নয়। এর পরিবর্তে তিনি প্রয়োজনে দাম্ভিক হতে চান; কেননা তাঁর বিশ্বাস– সত্যের দম্ভ যাদের মধ্যে রয়েছে তাদের পক্ষেই কেবল অসাধ্য সাধন করা সম্ভব।

নজরুল এই প্রবন্ধে দেখিয়েছেন যে, তিনি ভুল করতে রাজি আছেন কিন্তু ভণ্ডামি করতে প্রস্তুত নন। ভুল জেনে তাকে ঠিক বলে চালিয়ে দেবার কপটতা কিংবা জেদ তাঁর দৃষ্টিতে ভণ্ডামি। এই ভুল ব্যক্তির হতে পারে, সমাজের হতে পারে কিংবা হতে পারে কোনো প্রকার বিশ্বাসের। তবে তা যারই হোক আর যেমনই হোক এর থেকে বেরিয়ে আসাই নজরুলের একান্ত প্রত্যাশা।

তিনি জানেন, এই বেরিয়ে আসা সম্ভব হলেই মানুষের সঙ্গে মানুষের প্রাণের সম্মিলন ঘটানো সম্ভব হবে। মনুষ্যত্ববোধে জাগ্রত হতে পারলেই ধর্মের সত্য উন্মোচিত হবে, এক ধর্মের সঙ্গে অপর ধর্মের বিরোধ মিটে যাবে। সম্ভব হবে গোটা মানব সমাজকে ঐক্যবদ্ধ করা; আর এই ঐক্যের মূল শক্তি হলো সম্প্রীতি। এই সম্প্রীতির বন্ধন শক্তিশালী হলে মানুষের মধ্যে সহনশীলতা বাড়ে। ভিন্ন ধর্ম-মত-পথের মানুষের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ জাগে। আর এই সম্প্রীতির মধ্য দিয়ে উৎকৃষ্ট মানব সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব।

আমার পথ প্রবন্ধের ব্যাখ্যা

দ্রোহ, প্রেম ও সৌন্দর্যের কবি কাজী নজরুল ইসলাম ‘আমি’ সত্তাকে সর্বদা উচ্চস্থানে রেখেছেন তাঁর উদ্দীপনামূলক কবিতায় ও জাগরণী গানে। তিনি তাঁর প্রবন্ধ সাহিত্যে মানবমুক্তির অনুষঙ্গে আমিত্বের শক্তিকে জোরালো যুক্তি দিয়ে নিঃসংকোচে প্রকাশ করেছেন। ‘আমার পথ’ প্রবন্ধেও তিনি ‘আমি’ সত্তার মহত্ত্ব ও শক্তির কথা বলেছেন। ‘আমার পথ’ প্রবন্ধে নজরুল ইসলাম এমন এক ‘আমি’র কামনা করেছেন, যার পথ সত্যের যে সত্য প্রাবন্ধিক বলিষ্ঠভাবে প্রবন্ধের শুরুতেই বলেছেন, ‘আমার কর্ণধার আমি’।

প্রত্যেক ব্যক্তি তার ‘আমি’ সত্তাকে লালন করবে এবং ওই আমি সত্তা পরিচালিত হবে ব্যক্তির সত্য দ্বারা। যার ভেতরে ভয়, তার বাইরেও ভয়। যার ভেতরে মিথ্যা, সেই মিথ্যাকে ভয় করে। গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিস বলেছেন ‘Know thyself’, অর্থাৎ নিজেকে জানো। প্রাবন্ধিক এই দার্শনিক তত্ত্বের আলোকেই যেন পাঠককে জানাতে চান, নিজেকে চিনলে নিজের সত্যকে চেনা যায়, বোঝা যায়। নিজেকে চিনলে আপনা- আপনি মনের মধ্যে একটা শক্তি বা জোর আসে। সেই জোর বা শক্তির কারণে ভয়ের কাছে নতিস্বীকার অসম্ভব। নিজেকে চেনা, নিজের সত্য দ্বারা পরিচালিত হওয়া দাম্ভিকতা নয়। খুব বেশি বিনয় দেখাতে গেলে নিজের সত্যকে অস্বীকার করা হয়। প্রাবন্ধিক মনে করেন, মিথ্যা বিনয়ের চেয়ে অহংকারের পৌরুষ অনেক ভালো।

নিজের সত্যে অন্বিষ্ট ব্যক্তি স্পষ্টবাদী ও স্পষ্টভাষী হয়। এই স্পষ্টবাদিতা স্পর্ধা বা অহংকার নয়। স্পষ্ট কথায় অবিনয় থাকে। এ অবিনয়ে কষ্ট পাওয়াটা দুর্বলতা। নিজের সত্যের মহত্ত্ব ও শক্তিকে বোঝাতে প্রাবন্ধিক গান্ধীজির বক্তব্যের প্রসঙ্গ তুলে ধরেছেন, গান্ধীজির বক্তব্যের মূল সুর হলো স্বাবলম্বন। কিন্তু অবুঝ ভারতবাসী স্বাবলম্বনের মর্ম না বুঝে পরাবলম্বনের দিকে ঝুঁকল। পরাবলম্বনকে গুরুত্ব দিলে ব্যক্তিসত্তা অর্থহীন ও কার্যকরহীন হয়ে পড়ে। পরাবলম্বন ব্যক্তির অন্তরে একটা গোলামির ভাব নিয়ে আসে। যে দাম্ভিকতা মহাপুরুষোচিত, ইতিবাচক ও মানবকল্যাণমুখী, সে দাম্ভিকতাই অসাধ্য সাধন করে। ব্যক্তির জন্য, সমাজের জন্য, দেশের জন্য যা নেতিবাচক তা দূর করার জন্য প্রয়োজন আগুনের সম্মার্জনা, অর্থাৎ আগুন-সত্যের প্রয়োগ। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর একটি গানে বলেছেন, ‘আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে’— আগুন-সত্য সম্পর্কে প্রাবন্ধিকের দৃষ্টিই ওই গানের বাণীর মতো। ভণ্ডামি করে শ্রদ্ধা বা প্রশংসা পাওয়ার লোভ বর্জন করলেই দাসত্বমুক্ত হওয়া যায়।

ভুলের মধ্য দিয়েই সত্যের সন্ধান করতে হয়। ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।’ এ কথার মর্মই মানুষ-ধর্মের মূল সুর। আসলে মানুষ-ধর্মই বড়ো ধর্ম। মানুষে মানুষে প্রাণের মিল হলে সব ধরনের বৈষম্য, হিংসা, গোঁড়ামি দূর হবে। এক ধর্মের সাথে আরেক ধর্মের বিরোধ মিটে যাবে। একজন প্রকৃত ধার্মিক ব্যক্তি অন্য ধর্মকে ঘৃণা করতে পারে না। দেশের জন্য যা সত্য, যা মঙ্গলজনক শুধু সেটা লক্ষ করেই সত্যের অগ্নিঝান্ডা দুলিয়ে এগিয়ে যেতে হবে।

আমার পথ প্রবন্ধের নামকরণ

বিষয়বস্তুর অন্তর্নিহিত ভাবকে প্রাধান্য দিয়ে ‘আমার পথ’ প্রবন্ধটির নামকরণ করা হয়েছে। প্রাবন্ধিক এখানে এমন এক ‘আমি’র প্রত্যাশা করেছেন, যার পথ সত্যের পথ। সত্য প্রকাশে তিনি নির্ভীক ও সংকোচহীন। প্রাবন্ধিক অনায়াসে বলেছেন- আমার কর্ণধার আমি। আমার পথ দেখাবে আমার সত্য। প্রাবন্ধিক শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সত্য পথের মহিমা আলোচনা করেছেন। সুতরাং প্রবন্ধটির নাম ‘আমার পথ’ যথার্থ হয়েছে।

উৎস

‘আমার পথ’ প্রবন্ধটি কাজী নজরুল ইসলামের বিখ্যাত প্রবন্ধগ্রন্থ ‘রুদ্র-মঙ্গল’ থেকে সংকলিত হয়েছে।

রূপশ্রেণি: ‘আমার পথ’ একটি প্রবন্ধজাতীয় রচনা, যা দার্শনিক ভাবনায় সমৃদ্ধ।

ভাষারীতি: প্রবন্ধটি চলিত গদ্যরীতিতে রচিত।

আমার পথ প্রবন্ধের প্রসঙ্গ পরিচয়

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম রচিত আমার পথ প্রবন্ধের গুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ পরিচয় গুলো নিচে দেওয়া হলো-

‘আমি’ সত্তার মহত্ত্ব ও শক্তি: ‘আমার পথ’ প্রবন্ধে কাজী নজরুল ইসলাম ‘আমি’ সত্তার মহত্ত্ব ও শক্তির কথা বলেছেন। এ প্রবন্ধে তিনি এমন এক ‘আমি’র প্রত্যাশা করেছেন, যার পথ সত্যের যে সত্যের পরিচয় প্রসঙ্গে প্রাবন্ধিক বলিষ্ঠভাবে বলেছেন, ‘আমার কর্ণধার আমি’। প্রাবন্ধিক প্রত্যেক মানুষকে পূর্ণ এক ‘আমি’র সীমায় ব্যাপ্ত করতে চেয়েছেন; একই সঙ্গে এক মানুষকে আরেক মানুষের সঙ্গে মিলিয়ে আমরা হয়ে উঠতে চেয়েছেন। রুদ্র তেজে মিথ্যার ভয়কে জয় করে সত্যের আলোয় নিজেকে চিনে নিতে সাহায্য করে এই ‘আমি’ সত্তা। প্রত্যেক ব্যক্তি তার ‘আমি’ সত্তাকে লালন করবে। ‘আমি’ সত্তা পরিচালিত হবে ব্যক্তির সত্য দ্বারা। নিজেকে চিনলে নিজের সত্যকে চেনা ও বোঝা যায়। আর এতে নিজের মনের মধ্যে একটা শক্তি বা জোর আসে। আর এই শক্তির কারণে ভয়ের কাছে নতি স্বীকারের পথ চিরতরে রুদ্ধ হয়ে যায়।

জীবনে ভুলের অবস্থান: প্রাবন্ধিক ‘আমার পথ’ রচনায় মানুষের জীবনে ভুলের গুরুত্ব তুলে ধরেছেন। এই প্রবন্ধে তিনি বলেছেন, তিনি ভুল করতে রাজি আছেন, কিন্তু ভণ্ডামি করতে প্রস্তুত নন। ভুল জেনেও তাকে ঠিক বলে চালিয়ে দেবার কপটতা কিংবা জেদ তার দৃষ্টিতে ভণ্ডামি। এই ভুল হতে পারে ব্যক্তির, সমাজের কিংবা কোনো বিশ্বাসের। তবে ভুল যেমনই হোক তা আঁকড়ে না ধরে সেখান থেকে বেরিয়ে এসে প্রত্যেক মানুষ সত্যকে প্রতিষ্ঠা করবে— এটাই প্রাবন্ধিকের একান্ত প্রত্যাশা।

আত্মনির্ভরশীলতার গুরুত্ব: সমাজ ও সমকাল পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে প্রাবন্ধিক দেখেছেন, সুস্পষ্টভাবে নিজের বিশ্বাস আর সত্যকে প্রকাশ করতে না জানলে তৈরি হয় পরনির্ভরশীলতা; আহত হয় আমাদের ব্যক্তিত্ব। প্রাবন্ধিক এই পরনির্ভরশীলতা পরিহার করে আত্মনির্ভর হওয়ার প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন। তাঁর মতে, অন্যের মুখাপেক্ষিতা মানুষকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলে; মানুষের অন্তরে বাসা বাধে গোলামি। আর এই গোলামি থেকে মুক্তি দিতে পারে আত্মনির্ভরতা।

আগুনের সম্মার্জনা: ‘সম্মার্জনা’ শব্দের অর্থ মেজে-ঘষে পরিষ্কার রাখা। ‘আগুনের সম্মার্জনা’ বলতে সকল অশান্তি ও ক্লেদ পুড়িয়ে দূর করাকে বোঝায়। ‘আমার পথ’ প্রবন্ধে লেখক যে সমাজের ভিত্তি পচে গেছে তাকে সমূলে উপড়ে ফেলার পক্ষপাতী। এজন্য তাঁর মতে আগুনের প্রয়োজন। কারণ যা কিছু অশুভ তা সমূলে বিনষ্ট করাই তার অভিপ্রায়। আর আগুনই পারে সব রকম অশুদ্ধিকে পুড়িয়ে ছাই করে দিতে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button