আমি কিংবদন্তির কথা বলছি কবিতার ব্যাখ্যা ও মূলভাব
উচ্চমাধ্যমিক বাংলা প্রথম পত্রের আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ রচিত আমি কিংবদন্তির কথা বলছি কবিতার ব্যাখ্যা ও মূলভাব নিচে দেওয়া হলো।
‘আমি কিংবদন্তির কথা বলছি’ কবিতাটি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর আমি কিংবদন্তির কথা বলছি কাব্যগ্রন্থ থেকে সংক্ষেপিত আকারে সংকলিত হয়েছে। আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ রচিত আমি কিংবদন্তির কথা বলছি কবিতার ব্যাখ্যা নিচে দেওয়া হলো।
আমি কিংবদন্তির কথা বলছি কবিতার মূলভাব
কবিতাটি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ রচিত ‘আমি কিংবদন্তির কথা বলছি’-র নাম কবিতা। রচনাটিতে বিষয় ও আঙ্গিকগত অভিনবত্ব রয়েছে। আলোচ্য কবিতাটিতে উচ্চারিত হয়েছে ঐতিহ্যসচেতন শিকড়সন্ধ্যানী মানুষের সর্বাঙ্গিণ মুক্তি দৃপ্ত ঘোষণা। প্রকৃতপক্ষে, রচনার প্রেক্ষাপটে আছে বাঙালি সংস্কৃতির হাজার বছরের ইতিহাস; এই জাতির সংগ্রাম, বিজয় ও মানবিক উদ্ভাসনের অনিন্দ্য অনুষঙ্গসমূহ। তিনি এই কবিতায় পৌনঃপুনিকভাবে মানবমুক্তির আকাঙ্ক্ষায় সোচ্চার হন। কবির একান্ত প্রত্যাশিত মুক্তির প্রতীক হয়ে উপস্থাপিত হয় একটি বিশেষ শব্দবন্ধ ‘কবিতা’।
কবি তার পূর্বপুরুষের সাহসী ও গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের কথা উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে তাঁর বক্তব্যকে এগিয়ে নিয়ে চলেন। কবির বর্ণিত এই ইতিহাস মাটির কাছাকাছি মানুষের ইতিহাস; বাংলার ভূমিজীবী অনার্য ক্রীতদাসের লড়াই করে টিকে থাকার ইতিহাস। ‘কবিতা’ ও সত্যের অভেদকল্পনার মধ্য দিয়ে কবি নিয়ে আসেন মায়ের কথা, বোনের কথা, ভাইয়ের কথা পরিবারের কথা। কবি এ-ও জানেন মুক্তির পূর্বশর্ত যুদ্ধ। আর সেই যুদ্ধে পরিবার থেকে দূরে সরে যেতে হয়। ভালোবাসার জন্য, তাদেরকে মুক্ত করবার জন্যই তাদের ছেড়ে যেতে হয়। এই অমোঘ সত্য কবি জেনেছেন আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের ইতিহাস থেকে।
কবিতাটির রসোপলব্ধির অবিচ্ছেদ্য অংশ হলো এর আঙ্গিক বিবেচনা। এক্ষেত্রে, প্রথমেই যে বিষয়টি পাঠককে নাড়া দেয় তা হলো, একই ধাঁচের বাক্যের বারংবার ব্যবহার। কবি একদিকে, “আমি কিংবদন্তির কথা বলছি” পঙক্তিটি বারবার প্রয়োগ করেছেন, অপরদিকে “যে কবিতা শুনতে জানে না/সে…” কাঠামোর পঙক্তিমালার ধারাবাহিক উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে কবিতা আর মুক্তির আবেগকে একত্রে শিল্পরূপ প্রদান করেছেন। এখানে ‘কিংবদন্তি’ শব্দবন্ধটি হয়ে উঠেছে ঐতিহ্যের প্রতীক। কবি এই নান্দনিক কৌশলের সঙ্গে সমন্বিত করেছেন গভীরতাসঞ্চারী চিত্রকল্প। একটি কবিতার শিল্পসার্থক হয়ে ওঠার পূর্বশর্ত হলো হৃদয়স্পর্শী চিত্রকল্পের যথোপযুক্ত ব্যবহার।
চিত্রকল্প হলো এমন শব্দছবি যা কবি গড়ে তোলেন এক ইন্দ্রিয়ের কাজ অন্য ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে করিয়ে কিংবা একাধিক ইন্দ্রিয়ের সম্মিলিত আশ্রয়ে; আর তা পাঠক-হৃদয়ে সংবেদনা জাগায় ইন্দ্রিয়াতীত বোধের প্রকাশসূত্রে। চিত্রকল্প নির্মাণের আরেকটি শর্ত হলো অভিনবত্ব। এ সকল মৌল শর্ত পূরণ করেই আলোচ্য কবিতায় চিত্রকল্পসমূহ নির্মিত হয়েছে। কবি যখন বলেনঃ “কর্ষিত জমির প্রতিটি শস্যদানা কবিতা”; তখন এই ইন্দ্রিয় থেকে ইন্দিয়াতীতের দ্যোতনাই সঞ্চারিত হয়। নিবিড় পরিশ্রমে কৃষকের ফলানো ফসল একান্তই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য একটি অনুষঙ্গ। কিন্তু এর সঙ্গে যখন কবিতাকে অভেদ কল্পনা করা হয় তখন কেবল ইন্দ্রিয় দিয়ে একে অনুধাবন করা সম্ভব হয় না। সার্বিক বিবেচনায় কবিতাটি বিষয় ও আঙ্গিকের সৌকর্যে বাংলা সাহিত্যের এক অনন্য সংযোজন।
আমি কিংবদন্তির কথা বলছি কবিতার ব্যাখ্যা
কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর ‘আমি কিংবদন্তির কথা বলছি’ কবিতাটির মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতির দীর্ঘ ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাথে সমকালীন সমাজের একটি চমৎকার যোগসূত্র নির্মিত হয়েছে।
কবি তাঁর কবিতায় যেসব কিংবদন্তির কথা বলেছেন তা থেকে দেখা যায়, তাঁর পূর্বপুরুষেরা একসময় ক্রীতদাস ছিলেন। এ কারণে তাঁদের পিঠে ছিল রক্তজবার মতো লাল ক্ষত। তাঁরা পাহাড় এবং হিংস্র প্রাণীতে ভরা অরণ্য অতিক্রম করে এসেছিলেন। তাঁরা পতিত জমি আবাদ করতেন। তাঁদের করতলে ছিল পলিমাটির গন্ধ। তাঁদের উৎপাদিত যে শস্য তার প্রতিটি দানা ছিল একেকটি প্রাণবন্ত কবিতা। তাঁদের কণ্ঠে যে সত্য উচ্চারিত হতো তার প্রতিটি শব্দও ছিল কবিতা। কবির মতে, যে এই কবিতা শুনতে জানে না, সে ঝড়ের আর্তনাদ শোনে এবং দিগন্তের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। এমনকি আজন্ম সে ক্রীতদাসই থেকে যায়। তাই কবি উচ্চারিত সত্যের মতো স্বপ্নের কথা বলেন। উনোনের আগুনে আলোকিত উজ্জ্বল জানালার কথা বলেন। যে মা বলতেন, প্রবহমান নদী সাঁতার না জানা মানুষকেও ভাসিয়ে রাখে, কবি সেই মায়ের কথাও বলেন।
কবির মতে, যে কবিতা শুনতে জানে না সে নদীতে ভাসতে কিংবা মাছের সঙ্গে খেলা করতে পারে না। এমনকি সে মায়ের কোলে শুয়ে গল্পও শুনতে পারে না। কিংবদন্তি হিসেবে কবিতায় পূর্বপুরুষদের কথা বলার পাশাপাশি বিচলিত স্নেহ, গর্ভবতী বোনের মৃত্যু আর নিজের ভালোবাসার কথাও বলেন তিনি। কবির মতে, যে মায়ের মধ্যে বেশি ভালোবাসা থাকে তিনি বাঁচেন না, মরে যান। মানুষকে ভালোবেসে যে যুদ্ধ আসে, ভালোবাসায় সিক্ত মায়ের ছেলেরা সেখানে অংশ নিতে চলে যায়। কবির মতে, যে কবিতা শুনতে জানে না, সে সন্তানের জন্য মরতে কিংবা ভালোবেসে যুদ্ধে যেতে পারে না। এমনকি সে কখনো অসীম শক্তির উৎস সূর্যকেও তার হৃৎপিণ্ডে ধরে রাখতে পারে না। কবি মনে করেন— যে কর্ষণ করে শস্যের সম্ভার তাকে সমৃদ্ধ করে, যে মৎস্য লালন করে প্রবহমান নদী তাকে পুরস্কৃত করে, যে গাভীর পরিচর্যা করে জননীর আশীর্বাদ তাকে দীর্ঘায়ু করে; আর যে লৌহখণ্ডকে প্রজ্বলিত করে, ইস্পাতের তরবারি তাকে সশস্ত্র করে।
দীর্ঘদেহী পুত্রদের উদ্দেশে কবি আবারও তাঁর মায়ের কথার পাশাপাশি বোনের মৃত্যু, ভাইয়ের যুদ্ধে যাওয়া, নিজের ভালোবাসা এবং কবি ও কবিতার কথা বলেন। কবি মনে করেন— সশস্ত্র সুন্দরের অনিবার্য অভ্যুত্থান, সুপুরুষের ভালোবাসার সুকণ্ঠ সংগীত, রক্তজবার মতো প্রতিরোধের উচ্চারণ এবং জিহ্বায় উচ্চারিত প্রতিটি মুক্ত শব্দই কবিতা। কবি শেষ পর্যন্ত সংশয় ব্যক্ত করে বলেন, আমরা কি তাঁর মতো কবিতা কিংবা স্বাধীনতার কথা বলতে পারব!
এ কবিতায় যেমন কবির পূর্বপুরুষদের ওপর পাশবিক নির্যাতন ও তাঁদের সাহসী ও গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের কথা উপস্থাপন করা হয়েছে, তেমনই তাঁদের সমাজ, সংস্কৃতি, পরিবেশ ও অর্থনীতিরও একটি আবহ ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। সমসাময়িক রাজনীতি ও শাসনব্যবস্থার বিষয়টিও কবিতায় উঠে এসেছে। বাঙালি জাতির হাজার বছরের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের এক নিপুণ চিত্রকল্প এই কবিতাটি আমাদের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধকেও গভীরভাবে ধারণ করেছে। আঙ্গিকগত দিক থেকেও কবিতাটির গঠন অসাধারণ। সব মিলিয়ে বাংলা সাহিত্যের জন্যে এটি একটি অনবদ্য কবিতা হয়ে উঠেছে।
কবিতার নামকরণ
মূল বিষয়বস্তুর ওপর ভিত্তি করে ‘আমি কিংবদন্তির কথা বলছি’ কবিতাটির নামকরণ করা হয়েছে। লোকপরম্পরায় শ্রুত বা কথিত কথাকেই কিংবদন্তি বলে। কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ তাঁর পূর্বপুরুষ সম্পর্কে শ্রুতকথা বা কিংবদন্তিকে এই কবিতার প্রধান উপজীব্য করেছেন বলে এর নামকরণ ‘আমি কিংবদন্তির কথা বলছি’ অত্যন্ত সার্থক ও যুক্তিসংগত হয়েছে।
ছন্দ: ‘আমি কিংবদন্তির কথা বলছি’ কবিতাটি গদ্যছন্দে রচিত। প্রচলিত ছন্দের বাইরে গিয়ে এটি প্রাকৃতিক তথা স্বাভাবিক ছন্দে রচিত হয়েছে।
আমি কিংবদন্তির কথা বলছি কবিতার অনুষঙ্গ
কিংবদন্তি: ‘কিংবদন্তি’ শব্দের সাধারণ অর্থ জনশ্রুতি। ব্যাপক অর্থে ‘কিংবদন্তি’ হলো লোকপরম্পরায় শ্রুত ও কথিত এমন কোনো বিষয় যা একটি সমাজ বা জাতির ঐতিহ্যের পরিচয় বহন করে। আলোচ্য কবিতায় কবি পূর্বপুরুষদের সম্পর্কে জনশ্রুতির মাধ্যমে যা কিছু জেনেছেন, কাব্যিক সুষমায় তিনি তাই তুলে ধরেছেন। আর এটি তুলে ধরতে গিয়ে তিনি মূলত তাঁর স্বজাতি ও স্বদেশের ঐতিহ্যকেই রূপায়িত করেছেন। এখানে ‘কিংবদন্তি’ শব্দবন্ধটি হয়ে উঠেছে ঐতিহ্যের প্রতীক।
‘আমি কিংবদন্তির কথা বলছি’: কবিতার প্রেক্ষাপটে উঠে এসেছে বাঙালি সংস্কৃতির হাজার বছরের সংগ্রাম, বিজয় ও মানবিক উদ্ভাসনের ইতিহাস। কবি এখানে মানবমুক্তির আকাঙ্ক্ষায় সোচ্চার হয়েছেন বারবার। কবি তাঁর বক্তব্যে বাঙালি জাতির পূর্বপুরুষদের সাহসী ও গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের কথা উপস্থাপন করেছেন। বাংলার ভূমিজীবী অনার্য ক্রীতদাসের লড়াই করে টিকে থাকার ইতিহাস উঠে এসেছে এখানে। কবি মুক্তির পূর্বশর্ত হিসেবে যুদ্ধের অপরিহার্যতাকে তুলে ধরেছেন। তিনি মনে করেন, আমাদের পরাধীনতাই আমাদের ক্রীতদাস করে রেখেছে। তাই তিনি যুদ্ধের মাধ্যমে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হতে চেয়েছেন।